এম. শামছুুল আলম: বিশ্ব আরবি ভাষা দিবস বা আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস (World Arabic Language Day)। প্রতি বছর ১৮ই ডিসেম্বর এই দিবসটি পালিত হয়। জাতিসংঘ (United Nations) সাধারণ পরিষদের ৩১৯০ নং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে এই দিনে বিশ্ব আরবি ভাষা দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কারণ ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনেই জাতিসংঘের ৬ষ্ঠ দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় আরবি।
আরবি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা বর্তমান বিশ্বের আলজিরিয়া, বাহরাইন, চাঁদ, কমোরোস, জিবুতি, মিসর, ইরিত্রিয়া, ইরাক, ইসরাইল, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সোমালিয়া, সুদান, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন ও ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় ভাষা। এসব আরব দেশ ছাড়াও তুর্কি, মালয়েশিয়া ও সেনেগালে এ ভাষার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও কোরিয়ার মতো দেশ সমূহে আরবি সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজের মর্যাদায় পেয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী অমুসলিম দেশ ভারতেও এ ভাষার চর্চা ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়।
বিশ্বের ৪২২ মিলিয়ন আরব জনগোষ্ঠী এবং দেড় শ’ কোটিরও বেশি মুসলিম তাদের দৈনন্দিন জীবনে এ ভাষা ব্যবহার করেন। এছাড়াও বলা হয়ে থাকে, আরবি পৃথিবীর প্রাচীনতম ও অপরিবর্তনীয় ভাষা। এ ভাষায় সাহিত্যরস, সাহিত্যসম্ভার ও সাহিত্যের উপাদান অন্য যেকোনো ভাষার চেয়ে কম নয়। তাই আরবি ভাষা বাদ দিয়ে বিশ্বসাহিত্য হতে পারে না। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসও আরবি সাহিত্যের ইতিহাস ছাড়া রচিত হতে পারে না। তাছাড়া আরবি সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিবেচিত।
আরবি সাহিত্যের প্রাচীন কবি ইমরুল কায়েস (৫০০-৫৪৫) পাশ্চাত্যে ‘আরবের শেক্সপিয়ার’ নামে পরিচিত। সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মিশরীয় আরবি সাহিত্যিক নাগীব মাহফুজ (১৯১১-২০০৬) লাভ করেন নোবেল পুরস্কার। এতে অতি সহজেই আমাদের কাছে আরবী ভাষার মর্যাদা, গুরুত্ব এবং এ ভাষার প্রয়োজনীয়তা অনুমিত হয়। যদিও আরবি অত্যন্ত ঋদ্ধ ভাষা তথাপি, কোরআনের ভাষা ও সাধারণ দৃষ্টিতে ইসলামের ধর্মের সাথে সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতার ফলে পরবর্তী সময়ে ধর্ম নিরপেক্ষ ভাষার তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়ে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের পর ১৯৭৩ সালে এটিকে জাতিসংঘের ৬ষ্ঠ দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়; এবং ২০১০ সাল থেকে ১৮ই ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবসের মর্যাদা দেয় জাতি সংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ‘‘ইউনেসকো’ʼ (UNESCO)।
এই দিবসের ইতিহাস খুব সংক্ষিপ্ত নয়। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর দাপ্তরিক ভাষা ছিল পাঁচটি। ইংরেজি, ফ্রান্স, চীন, রুশ ও স্প্যানিশ। আর বিশ্বের বিভিন্ন দিক থেকে বিশেষ ভূমিকা ও আরবি ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশী হওয়া সত্ত্বেও আরব নেতাদের আরবি ভাষা ব্যবহারের কোনো সুযোগ ছিল না। ভিনদেশী ভাষাতেই তাদের বক্তব্য প্রদান ও শ্রবণ করতে হতো। দাপ্তরিক কাগজপত্র আরবি থেকে অনুবাদ করে তা দাপ্তরিক ভাষায় উপস্থাপন করতে হতো। এ অবস্থা আরবদের জন্য ও বিশেষভাবে আরবি ভাষার জন্য ছিল লজ্জাজনক। তাই শুরু থেকেই আরব নেতারা এদিকে সজাগ ছিলেন। সর্বপ্রথম সাউদি আরব ও মরক্কো সরকার এবিষয়ে কথা বলেন। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৫৪ সালে ৪ঠা ডিসেম্বর তাদের নবম অধিবেশনে ৮৭৮ নং প্রস্তাবে আরবি ভাষায় লিখিত অনুবাদ প্রকাশের বৈধতা প্রদান করে। এবং বছরে চার হাজার পৃষ্ঠা অনুবাদের একটি সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। সাথে সাথে এ শর্ত জুড়ে দেয়া হয় যে, অনুবাদের ব্যয়কৃত অর্থ সংশ্লিষ্ট দেশকে বহন করতে হবে এবং নথি ও কাগজপত্র আরব এলাকার রাজনৈতিক ও আইন বিষয়ক হতে হবে।
১৯৬০ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ‘‘ইউনেসকো’’ আরব দেশগুলোতে আরবি ভাষায় সভা সেমিনার ও জাতীয় সম্মেলন পরিচালনা এবং তাদের নিজস্ব নথিপত্র ও প্রচারপত্র আরবীতে প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৬৬ সালে সাধারণ সভাগুলোতে ভিন্ন ভাষা থেকে আরবি ভাষায় এবং আরবি ভাষা থেকে ভিন্ন ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পর্যায়ক্রমে ১৯৬৮ সালে অনুবাদের সাথে সাথে আরবি ভাষাকে ইউনেসকোর সাধারণ সভা ও কর্ম পরিষদের কার্যকরি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়।এই ধারাবাহিকতার সাথে সাথে আরব বিশ্বের কূটনৈতিক চাপ ও চেষ্টা অব্যাহত থাকে। এতে সাউদি ও মরক্কো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। শেষ পর্যন্ত তারা ১৯৭৩ সালে আরবি ভাষাকে জাতিসংঘের সাধারণ সভার মৌখিক ভাষা হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাতে সমর্থ হয়। পরবর্তীতে আরব লীগ তাদের ষাটতম অধিবেশনে এই সিদ্ধান্ত নেয় যে, আরবীকে জাতিসংঘসহ তার অন্যান্য সংস্থাগুলোর দাপ্তরিক ভাষা করতে হবে। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের ২৮ তম অধিবেশনে ৩১৯০ নং সিদ্ধান্তেআরবি ভাষাকে জাতিসংঘ ও তার সংশ্লিষ্ট সংস্থার দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
২০১২ সালের অক্টোবরে ইউনেসকোর নির্বাহী পরিষদের বৈঠকের ১৯০ তম অধিবেশনে ১৮ই ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক আরবী ভাষা দিবস ঘোষণা করা হয় এবং এর পর থেকে সেই দিনটি ‘আন্তর্জাতিক আরবী ভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে।
ইতিহাস-ঐতিহ্য যাই হোক আরবি ভাষা-ভাষী লোক তথা তাবৎ দুনিয়ার মানুষ বিশেষত মুসলমানদের জন্য এই দিবসটি অত্যন্ত তাৎপর্য বহন করে। প্রতি বছর তাই ১৮ই ডিসেম্বর সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের চারটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগ যথাক্রমে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও আলিয়া ও ক্বওমীয়া মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দিনটিকে পালন করে মুসলিম জাতির আত্মপরিচয়ের উপলব্ধি থেকেই। একটি আন্তর্জাতিক দিবস সার্বজনীন পালিত হোক, এরূপ প্রত্যাশা তাদের।
তথ্য সূত্রঃ উইকিপিডিয়া, মাসিক আল-কাউসার (ডিসেম্বর, ২০১৪)
লেখকঃ শিক্ষার্থী-চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন