আফতাব চৌধুরী: পাখির ডাক ও গান নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কত যে ছড়া কবিতা, গান ও গল্প লেখা হয়েছে তা গুনে শেষ করা যায় না। ভোর বেলায় গাছের মগডালে বসে দোয়েল পাখির গান কিংবা গরমের দুপুরে কোকিলের কহু ডাক শুনতে কার না ভাল লাগে। অন্যদিকে আবার পাপিয়ার একঘেয়ে আওয়াজ অতিষ্ঠ হয়ে ইংরেজরা ওই পাখির নাম দিয়ে ছিলেন—’ব্রেনফিভার বার্ড’। এখন সারা পৃথিবীর পাখির গান ও শব্দ সাহিত্যের আঙ্গিনা ছাপিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছে।
পাখির গলার আওয়াজকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। পাখির ডাক ও পাখির গান। পাখির ডাক হল সরল ক্ষণস্থায়ী আওয়াজ, যা সারা বছর ধরে পুরুষ ও স্ত্রী পাখীর গলা দিয়ে বের হয়। পাখির গানের আওয়াজ হল জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী। প্রধানত পুরুষ-পাখিরাই প্রজনন ঋতুতে গান গায়। গানের ভাষায় আমরা যাকে নোট বা স্বর বলি। পাখির ডাক সেই একটা স্বরে তৈরি। অন্যদিকে পাখির গান অনেক স্বরের সমষ্টি। আমরা যখন আদর বা রাগ করে কিংবা ভয় পেয়ে কাউকে ডাকি তখন আমাদের গলার স্বরও পালটে যায়। পাখিদের মধ্যেও এ একই ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। গাছের পাখিরা প্রায় ২০ রকম করে ডাকতে পারে। যার মানে তারা নিজেদের মধ্যে ২০ রকমের সংবাদের আদান প্রদান করে। বাবুই পাখিরা ১০ রকমের ডাক ডাকে। এসব ডাকের মধ্যে আছে অন্যকে ভয় দেখাবার ডাক, সঙ্গীকে ডাক, উড়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তের ডাক, অন্য পাখিদের শিকারিদের থেকে সাবধান করে দেওয়ার ডাক ইত্যাদি।
একটি পাখির বিশেষ ডাকের উদ্দেশ্য শুধু সে প্রজাতির পাখিরাই বুঝতে পারে। মূলত দুটি কারণে পাখীরা গান গায়। প্রথমত গান গেয়ে তারা নিজেদের পরিচয় ও অবস্থান জানিয়ে দেয়। প্রজননের জন্য এটা খুব জরুরি। দ্বিতীয়ত, গান গেয়ে তারা নিজেদের সীমানা দখলে রাখে। এ ব্যাপারে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষী বিশেষজ্ঞ জেন ক্রেব পরীক্ষা চালান।পাখীদের গান গাওয়ার ক্ষমতাটি কিন্তু জন্মগত নয়। গান শেখার জন্য শিশু পাখিদের রীতিমত তালিম নিতে হয় বড়দের কাছ থেকে। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার পর পাখিদের শব্দ নিরোধক বাক্সে আটকে রেখে দেখা গেছে, তাদের গলা দিয়ে এলোমেলো স্বর বের হচ্ছে। সে স্বরের সঙ্গে ওই পাখির গানের নোটের কোনও মিল নেই।
কিছু পাখি আছে যারা গলার স্বর ছাড়াও লেজ, ডানা কিংবা ঠোঁট দিয়ে যান্ত্রিক শব্দ করে। সে সব শব্দেরও অনেক সময় বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে। আমাদের দেশের সোনাজঙ্গা পাখির গলার শব্দ প্রায় শোনা যায় না বললেই লে। ওরা লম্বা দুটি ঠোঁট বাজিয়ে শব্দ করে। আফ্রিকার এক প্রজাতির লার্ক পাখি ডানা দিয়ে এমন শব্দ করে যে, এনে হয় যেন গান গাইছে। কাঠাঠোকরা পাখীরা যে গাছের ডালে ঠোঁট ঠুকে শব্দ করে, তা আমাদের অনেকেরই জানা। এরা সেকেন্ড ২৫ বার পর্যন্ত গাছের মরা ডালে ঠোঁট ঠুকতে পারে। অনেকে আবার ধাতুর টেলিগ্রাফ ওলেকট্রিক পোস্টে ঠোঁট ঠুকে শব্দ করে।
গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের বেশ কিছু পাখি ডুয়েট গাইতে পারে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে স্ত্রী-পাখী পুরুষ-পাখির সঙ্গে এমন ভাবে গলা মেলায় যে, মনে হয় একটি পাখিই গাইছে। এক রকমের ছাতারে পাখীও এ ডুয়েট গান গাইতে টু। অনেক পাখী আবার আমাদের মতো রিমেক গানও গাইতে পারে। নকল করতে পারে অন্য পাখীর ডাকওান। হরবোলা পাখি দোয়েল, চাতক, ফিঙ্গে, টুনটুনি, বুলবুল প্রভৃতি পাখীর ডাক হুবহু নকল করতে পারে অন্যদিকে পাহাড়ি ময়না ও ভীমরাজ পাখীরা ধনেশ, ঈগল, কাঠঠোকরা, ছাতারে, কোয়েল, এমনকী শ্যাম পাখীর রেলা গান নকল করতে ওস্তাদ। টিয়া আর পাহাড়ি ময়না মানুষের গলা নকল করতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন