নিজ বহরে থাকা উড়োজাহাজে একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটিতে দিশাহারা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এ ছাড়া নিজ বহর থেকে ২টি উড়োজাহাজ কমে যাওয়া, বহরে থাকা ৪টি উড়োজাহাজ-সংকট আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এ জন্য ফ্লাইট শিডিউল বিপর্যয়ে ভুগছে এয়ারলাইন্সটি। বুধবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একাধিক আন্তর্জাতিক ফ্লাইট নির্ধারিত সময়ে ছাড়তে পারেনি। উড়োজাহাজ সংকটের কারণ দেখিয়ে কয়েক ঘণ্টা থেকে আধা ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্ব হয়েছে এসব ফ্লাইট, যা যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়িয়েছে।
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমানের উড়োজাহাজগুলোর বয়স হয়েছে, এগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ হলে এত যান্ত্রিক ত্রুটি হওয়ার সুযোগ নেই। ঘন ঘন যান্ত্রিক ত্রুটির পেছনে বিমানের গাফিলতি ও ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ না করাই দায়ী। গত ২-৩ বছরে যেসব ‘লগ এন্ট্রি’ হয়েছে সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা এবং সম্পূর্ণ অডিট করার পরামর্শ তাদের। না হলে অচিরেই বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন তারা।
আর বিমান বলছে, ঘন ঘন যান্ত্রিক ত্রুটি হওয়া দুর্ভাগ্যজনক। কারণ খুঁজে বের করতে কাজ চলছে। প্রতিটি যান্ত্রিক ত্রুটিই ‘ইউনিক’। তাদের উড়োজাহাজ সংকট রয়েছে। একটা উড়োজাহাজের সমস্যা হলে অন্যগুলোর ওপর বেশি চাপ পড়ে। এসব কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সূত্রে জানা গেছে, কয়েকটি উড়োজাহাজ গ্রাউন্ডেড থাকায় শিডিউলে সমস্যা হয়েছে। এ জন্য ঢাকা থেকে মদিনাগামী ফ্লাইট বিজি-২৩৭ আজ (বুধবার) চার ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়েছে। ঢাকা থেকে জেদ্দাগামী ফ্লাইট বিজি-১৩৫ আধা ঘণ্টা দেরিতে ছেড়েছে। ঢাকা থেকে কুয়েতগামী ফ্লাইট বিজি-৩৪৩-এরও দেড় ঘণ্টা বিলম্ব হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা থেকে দুবাইগামী ফ্লাইট বিজি-১৪৭ অপারেশনাল কারণে ৪ ঘণ্টা বিলম্বিত হবে।
ঘন ঘন যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান মফিদুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, বিমানের উড়োজাহাজে ঘন ঘন যান্ত্রিক ত্রুটি ঘটছে এটা দুঃখজনক। বিমানের বহর অনেকটাই নতুন, সেখানে যান্ত্রিক ত্রুটি হবে কিন্তু এত বেশি ত্রুটি অপ্রত্যাশিত। যে পরিমাণে হচ্ছে সেটা এলার্মিং। তিনি বলেন, যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত আছেন তারা ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না। এখন আধুনিক যুগ। টেকনিক্যাল ফল্টগুলো আগে থেকেই আইডেন্টিফাই করা যায়। সেই সিস্টেম রয়েছে। প্রেডিক্টেড রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়। এখন এআইয়ের সময়, পিরিয়ডিক রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে, একটা নির্দিষ্ট সময় পরে উড়োজাহাজগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। এগুলো ঠিকমতো হলে এত যান্ত্রিক ত্রুটি হওয়ার কথা না। এখানে যারা সুপারভিশন করছেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত আছেন তাদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এগুলো দেখতে হবে। আমি মনে করি, বিমানের দায়িত্বপ্রাপ্তদের এখন অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে এগুলো দেখা উচিত। না হলে এখন যান্ত্রিক ত্রুটি হচ্ছে কদিন পরে বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। যারা কাজ করছে তাদের কাজ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার (অব.) এটিএম নজরুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, বিমান পচে গেছে। বিমানের বহরে থাকা উড়োজাহাজগুলোর বয়স হয়ে গেছে। ১০ বছর হলো এগুলো বাংলাদেশে এসেছে। এগুলোর ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে কি না সেটা দেখার দায়িত্ব বিমানের।
তিনি বলেন, একটাতে ফ্ল্যাপের সমস্যা, আরেকটাতে ইঞ্জিনের সমস্যা, এগুলো থেকে বোঝা যায় ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না। বিমানের উচিত হবে গত ২-৩ বছরে যেসব ‘লগ এন্টি’ হয়েছে এগুলো অডিট করে দেখতে হবে আসলে কাজগুলো হয়েছে কি না। এই জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সব উড়োজাহাজ ইনস্পেকশন করতে হবে। না হলে বড় দুর্ঘটনা হলে দায় কে নেবে।
নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিটি জিনিসেরই একটা লাইফ টাইম আছে, প্রতিটি পার্টসের লাইফ আছে। এ জন্য টেস্ট করে দেখতে হবে সেটা ঠিক আছে কি না। লাইফ থাকলেও সেটা যে কর্মক্ষম সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্যই অডিট করতে হবে। রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়ায় নজরদারি জোরদার করার পরামর্শ দেন তিনি।
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম সময়ের আলোকে বলেন, মানুষ বুড়ো হলে যেমন অঙ্গগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। তেমনই বিমানের উড়োজাহাজগুলো পুরোনো হয়ে গেছে, সে জন্য নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। গড়ে সবগুলোর বয়স ১০ থেকে ১২ বছর হয়ে গেছে। কাজেই যত পুরোনো হবে সমস্যা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা ততই বাড়বে। এগুলো ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ হলে তা থেকে অব্যাহতি পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, আমরা হয়তো ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছি না। আমাদের যে দক্ষতা দরকার তা দেখাতে পারছি না। এ জন্য বারবার ত্রুটি দেখা দিচ্ছে।
ওয়াহিদুল আলম বলেন, বিমানের কারিগরি টিমকে আরও দক্ষতাসম্পন্ন হতে হবে। যে চেকগুলো দরকার সেগুলো টাইমলি করতে হবে। উন্নতমানের রিপ্লেসমেন্ট পার্টস লাগাতে হবে। বিমানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োগের বিষয়ে স্বজনপ্রীতি-দুর্নীতি এসে যায়, পাইলট নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে বিভিন্ন স্তরে। নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি লেগেই থাকে। কারিগরি বিষয়ে দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতি করে সুযোগ দেওয়া হলে তারা তো সেই কাজটা ঠিকভাবে করতে পারবে না। এখানে কোনোরকম শৈথিল্য দেখানোর সুযোগ নেই। বিমানের রক্ষণাবেক্ষণে ইঞ্জিনিয়ার টেকনিশিয়ানদের সর্বোচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন হতে হবে এবং কম্পিটেট হতে হবে ও সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। বলা হয় কমিটি করা হয়েছে, কিন্তু কাউকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে—এটা শুনিনি। আসলে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
বিমানের জিএম (পিআর) এ বি এম রওশন কবির সময়ের আলোকে বলেন, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। গত ১ থেকে ২ মাসের মধ্যে আমাদের অনেকগুলো জাহাজে টেকনিক্যাল সমস্যা দেখা দিয়েছে। এটা আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা খতিয়ে দেখছেন। প্রতিটি প্রবলেম ইউনিক, একটার সঙ্গে আরেকটার মিল নেই। এমন না যে একই ঘটনা বারবার হচ্ছে। হয়তো দুয়েকটা ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। কী কারণে ঘন ঘন হচ্ছে তা ইঞ্জিনিয়াররা খুঁজে দেখছেন।
তিনি বলেন, আমাদের ২টা লিজের উড়োজাহাজ ফেরত দেওয়া হয়েছে। সে হিসেবে উড়োজাহাজের সংকটও রয়েছে। একটা উড়োজাহাজ যখন গ্রাউন্ডেড হয়ে যায় তখন অন্য উড়োজাহাজের ওপর চাপ পড়ে। তখন অন্য উড়োজাহাজগুলোকে ঘন ঘন ব্যবহার করতে হয়। এসব কারণেই এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে ফরমাল কোনো কমিটি হয়নি। তবে কেন অল্প সময়ে এতগুলো ঘটনা ঘটেছে সেটা ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে অনুসন্ধান করছে। ২৫টি বোয়িং কেনার সিদ্ধান্তের সঙ্গে বহরে থাকা উড়োজাহাজগুলোর যান্ত্রিক ত্রুটির যোগসূত্রের বিষয়টি উড়িয়ে দেন তিনি।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন