৭ নভেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনন্য উজ্জ্বল ঘটনা। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের শত্রুদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়েছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। এই ঐতিহাসিক দিনটি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীদের নিকট একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর এ দেশে শুধু সরকারের প্রকৃতি নয় বরং রাষ্ট্রের আদর্শগত চরিত্রেরও মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়। প্রকৃত অর্থে সেদিন একটি বিপ্লব সংঘটিত হয়। একটি সফল বিপ্লবের সকল বৈশিষ্ট্য যাতে বিদ্যমান ছিল।
বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও দার্শনিক হ্যানা অ্যারেন্ডটের (Hanna Arendt) এর মতে, ‘বিপ্লবে ইতিহাসের গতিধারা হঠাৎ করে নতুন এক মোড় নেয় এবং সূচনা হয় সম্পূর্ণ এক নতুন কাহিনীর, যে কাহিনী এর আগে জানা যায়নি বা বর্ণিত হয়নি।’ আর এই বিপ্লবের মাধ্যমেই বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে পাদপ্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের ‘রাখাল রাজা’খ্যাত জেনারেল জিয়াউর রহমান। জিয়াকে বলা হয় বাংলাদেশের অদৃষ্টের সন্তান। বাংলাদেশের ইতিহাস বারংবার তাকে প্রদীপের আলোয় নিয়ে আসতে চেয়েছে। তিনিও পিছপা হননি, স্বগর্বে এসেছেন সামনের কাতারে, নেতৃত্বও দিয়েছেন স্বমহিমায়। সাহসিকতার চরম পরীক্ষায় তিনি বারবার উত্তীর্ণ। ইতিহাসের সঙ্গে সাক্ষাৎকার যেন তাঁর ললাটের লিখন।
১৯৭১ সালের মার্চে এ দেশের স্বাধীনতাপাগল মানুষের আকাঙ্ক্ষা প্রতিধ্বনিত করে তিনি যখন বললেন, ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’…সেদিন তিনি চট্টগ্রাম সেনা ছাউনির একজন অখ্যাত মেজর মাত্র। কিন্তু ওই একটি ঘোষণা তাঁকে অমরত্ব দিল, স্থান দিল বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাতায়। ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫ ছিল শহীদ জিয়ার সাথে ইতিহাসের দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার। প্রথম সাক্ষাৎ ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে।
৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানের কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল না তা ঐতিহাসিকভাবে সত্য প্রমাণিত, আর অভ্যুত্থানের পূর্বনির্ধারিত কোনো নেতাও ছিলেন না। পরবর্তীকালে জিয়ার ওপর যদিও নেতৃত্ব অর্পিত হয়, তা ছিল চলমান ঘটনার পরিণতি এবং সেনাবাহিনীতে তখন জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা ও নেতৃত্বের কোনো বিকল্পও ছিল না। ৩, ৪ ও ৫ নভেম্বর- এই তিন দিন বাংলাদেশে কার্যত কোনো সরকার ছিল না। খন্দকার মোশতাক তখন নামমাত্র প্রেসিডেন্ট। খালেদ মোশাররফের পছন্দে বিচারপতি সায়েম ৬ নভেম্বর সকালবেলা প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হন। এই কয় দিন রেডিও-টেলিভিশন বন্ধ ছিল। ফলে দেশে কী ঘটছে, না ঘটছে কিছুই জানতে পারছিল না সাধারণ মানুষ। একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। বঙ্গভবনের ‘মেজর গ্রুপের’ সঙ্গে আপস করে, তাদের সব বন্দোবস্ত করে নিরাপদে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেও ক্ষমতা সংহত করতে পারেননি খালেদ মোশাররফ।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক, সামরিক বিশ্লেষকদের মতামতের নির্যাস এমনই দাঁড়ায় যে, ১৯৭৫ সালে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীতে সংঘাত সৃষ্টির পেছনে দেশের ভেতর থেকে মহলবিশেষের উসকানি ছাড়াও সীমান্তের বাইরে থেকে ইন্ধন জোগানো হয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার খালেদের নেতৃত্বে ৩ নভেম্বরের স্বল্প সময়ের সাফল্য নিয়ে সংশয় দেখা দিলে সীমান্তের বাইরের চক্রান্তকারীরা (ভারত) তাদের ‘Second Defense Line’ কে সক্রিয় করে তোলে। খালেদের বিরুদ্ধে সাধারণ সৈনিকদের ক্ষোভ আঁচ করতে পেরে জাসদের ‘গণবাহিনী’ এবং ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার’ কিছু লোক তাদের অনুভূতির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সঙ্গে ভিড়ে যায়। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মঈন দৈনিক প্রথম আলোয় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত স্মৃতিচারণায় উল্লেখ করেন, ‘৭ নভেম্বর প্রথম প্রহরে ওপরে উল্লিখিতদের কয়েকজন রেডিও থেকে বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার চালাতে থাকে যে, কর্নেল তাহের হলেন সিপাহি-জনতার বিপ্লবের নেতা! কিছুক্ষণের মধ্যে সাধারণ সৈনিকরা গিয়ে তাদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হলে বিপ্লবের সত্যিকার বাণী প্রচার হতে থাকে।
অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহের এরপর জিয়াউর রহমানের কাছে গিয়ে তাঁকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেখানে উপস্থিত ব্রিগেডিয়ার আমিনুল হক তৎক্ষণাৎ বাধা দেন। ফলে তখন জিয়াকে আর নেওয়া যায়নি। ব্রিগেডিয়ার হকের আশঙ্কা ছিল, রেডিও স্টেশনে নেওয়ার কথা বলে পথিমধ্যে জিয়াউর রহমানকে হত্যার পরিকল্পনা করেছে চক্রান্তকারীরা।’ উল্লেখ্য, তখন জেনারেল জিয়াকে রেডিও স্টেশনে না পাঠিয়ে একটি রেকর্ডিং ইউনিটকে জিয়ার বাসায় নিয়ে আসা হয়। এভাবেই ওই শুক্রবার সকালে তাঁর রেকর্ডকৃত ভাষণ প্রচার করা হয়।
অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস তাঁর ‘বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন- “ইতোপূর্বে গ্রেপ্তারকৃত জাসদ নেতা মেজর (অব.) জলিল, আ স ম আবদুর রব ও মোহাম্মদ শাহজাহান মুক্তি পান ৭ নভেম্বর। মুক্তি পেয়ে তাঁরা জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে শ্রেণী সংগ্রামের উদ্দেশ্যে সৈনিকদের একত্র করার চেষ্টা চালান। এ উদ্দেশ্যে প্রচারপত্র ও লিফলেটে ক্যান্টনমেন্ট এলাকা প্লাবিত করে দেওয়া হয়। বিপ্লবী ‘সৈনিক সংঘর্ষের’ ১২ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সৈনিকদের একত্র হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অস্ত্র জমা না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।” এভাবেই জেনারেল জিয়ার সঙ্গে গণবাহিনী আর বিপ্লবী সৈনিক সংঘর্ষের মোকাবিলার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে যায়। সেনা সদরের নিরাপত্তার জন্য জেনারেল জিয়া যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে সপ্তম, নবম, একাদশ ও দ্বাদশ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডো দলকে ৯ তারিখের মধ্যেই ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেনাবাহিনীর বেতন বৃদ্ধি, বাসস্থান ও পোশাকের প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণসহ অবমাননাকর ‘ব্যাটম্যান’ প্রথা বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন জিয়া। এতে জওয়ানদের মনোভাব সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। সৈনিকদের মধ্যে জিয়ার জনপ্রিয়তা তখন আকাশচুম্বী। ফলে জাসদের হঠকারী রাজনীতি এবং ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা ও কর্মকাণ্ড ব্যর্থ হয়ে যায়। এর পরই জাসদের বিরুদ্ধে সরকারি অভিযান শুরু হয় এবং মেজর (অব.) জলিল, আ স ম রব, হাসানুল হক ইনু ও কর্নেল তাহেরের ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে আত্মগোপন অবস্থা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় কর্নেল (অব.) তাহেরকে। এর দুই দিন পরই ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে হাইজ্যাক করে জিম্মি রেখে তাহেরকে মুক্ত করার জন্য ভারতীয় দূতাবাসে হামলা করা হয়। সেই অভিযানে কর্নেল তাহেরের এক ভাই নিহত হন এবং আরেক ভাই গুরুতর আহত হয়ে বন্দি হন।
এ ধরনের অনেক অশুভ তৎপরতা, সাহস ও বিচক্ষণতার সঙ্গে মোকাবিলা করেই ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের মূল চেতনাকে অক্ষুণ্ন, অম্লান রাখতে সক্ষম হন জেনারেল জিয়া। সিপাহি-জনতা ছিল তাঁর সঙ্গী-সারথী। জিয়াউর রহমানের ভূমিকার প্রশংসা করে ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন ব্যর্থ অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিল ‘Holiday’ পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘প্রকৃত প্রস্তাবে জিয়াই জাতিকে সার্বিক নৈরাজ্য থেকে রক্ষা করেছেন। ৭ নভেম্বরে রক্ষা করেছেন ভারতের পুলিশ অ্যাকশন থেকে (Zia in fact saved the nation from total anarchy and a possible police action from India on 7th November.)।
শহীদ জিয়ার জনপ্রিয়তাকে অস্বীকার করার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়েও ফ্যাসিস্ট সরকার ও তার দোসর মিডিয়া জণগণকে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। কারণ বাংলাদেশ যখনই নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে, জনগণ যখন অধিকার হারা হয়ে চাতক পাখির মতো আকাশপানে তাকিয়ে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় প্রহর গুনছিল তখনই ত্রাণকর্তার ভূমিকায় আবির্ভুত হয়েছিলেন বাংলার রাখাল রাজা। তাই ৭ই নভেম্বর ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস অপূর্ণ।
পরিশেষে, অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে ৭ই নভেম্বরকে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে বিধৃত করে এই ঐতিহাসিক দিনটিকে ‘সরকারি ছুটি’ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি।
লেখক
আসিফুল ইসলাম নূরী
সাবেক সহ-সভাপতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল।
Views: 33
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন